পিনাকী চট্টোপাধ্যায়
সিডনি
অচৈতন্য হয়ে মেয়েদের বাথরুমের একেবারে দরজার ওপর পড়ে রয়েছে মনসুর। নিমীলিত চোখ। শরীরে কোন সাড় নেই। নাম ধরে ডাকলেও কোনও সাড়া দিচ্ছে না। শুধু বুকটা খুব জোরে জোরে এবং খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। একটা ফোন করলেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে কয়েক মিনিটের মধ্যে কিন্তু সেই ফোন কেউ করতে চাইছে না। রেস্তেরার অন্য কর্মীরা ছুটে এসেছেন। সকলেই কিংকর্তব্য বিমুঢ। চিকিৎসা পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে যে জীবনহানির আশংকা রয়েছে সেটা জেনেও কেউ পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। তার কারন একটাই অস্ট্রেলিয়াতে মনসুরের কোন বৈধ পরিচয় নেই। চিকিৎসা এদেশে অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ যদি এদেশে থাকার বৈধতা না থাকে।
শুধু তাই নয়, কেউ এগিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে পারছে না তার একটা অন্য কারণও রয়েছে। বৈধ পরিচয়য়ের ব্যাপারটা যেমন সত্যি, তেমনেই যদি নিশ্চিত অবৈধ বাসিন্দা হয় তার আবার অন্য বিপদ রয়ছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আবার প্রশ্ন উঠবে, যদি অভিবাসনের চোখে বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে তবে এই ব্যক্তি এখানে চাকরি করতে পারে কি করে। এবার দায় এসে পড়বে রেস্তেরার মালিকের উপর। এত কিছুর ভাবনা চিন্তার পরে কি ঠিক হবে মনসুর চিকিৎসা পাবে, নাকি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। যে সব প্রশ্ন নিয়ে বিচলিত হয়ে একটা ফোন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, মৃত্যুর পরে তো সেই প্রশ্ন আরও অনেক বড় জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়াবে। তখন তো মৃত্যু কে কেন্দ্র করে আইন তো অন্য পথে চলবে।
এই মনসুর কয়েক দিন আগেই বলছিল যে কিভাবে একজন বাংলাদেশী ট্যাক্সি ড্রাইভার বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন এই একই কারনে। নিউটাউন এর ওপর দিয়ে ফাঁকা ট্যাক্সি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করেন। আগে থেকেই ছিল সমস্যা। আগের বারে ভেবেছিলেন ঠিক হয়ে যাবে। হয়নি। প্রচুর ঋণ এর বোঝা মথায় নিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন ট্যাক্সির ড্রাইভার এর আসনে। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। দুই সন্তান এবং তাদের জননীকে রেখে অনন্তলোকের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
এই মনসুর এর থেকেই শোনা পি সি পাসপোর্ট এর কি মহিমা। পি সি – কথাটার অর্থ – ফোটো চেঞ্জ। অর্থাৎ ফোটো চেঞ্জ পাসপোর্ট। তারই বা মানে কি। যখন কারো ভিসার আবেদন না মঞ্জুর হয়ে যায় তখন এই পি সি পাসপোর্টের শরণাপন্ন হতে হয়। মানে পাসপপোর্ট অন্য কারোর- যার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ভিসা রয়েছে। এবার সেই পাসপোর্টের বায়ো পেজে যার ছবি আছে সেই ছবি কারসাজি করে সরিয়ে নেওয়া হবে আর বসে যাবে অন্য আর একজনের ছবি। সেই তখন ভিসার বৈধ মালিক। অনেক টাকায় কিনতে হয় এই পি সি পাসপোর্ট তবে মনসুরের এই পাসপোর্ট ছিল কি না তা কখনও জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি। এই গেল বাংলাদেশের মনসুরের কথা। এসব আজকের কথা নয়, না হোক পঁচিশটি বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে। সেদিনের সেই সব আইন কানুন এখন একেবারে পাল্টেছে।
করাচীর ছেলে হাসান আর চিমা। সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। একই রেস্তেরার এক রান্নাঘরে কাজ করে দুজনে। একজন কারি শেফ আর অন্যজন তন্দুর শেফ। কাজের মধ্যেই এ ওকে ফুট কাটে। বাগ-বিতন্ডা থেকে হাতাহাতি শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাতে এক পক্ষ এসে অক্সিজেন দেয়। অন্য পক্ষে রম্ভা উর্বশী না থাকলেও দমকল দমকল করে চেঁচাবার লোকেরও অভাব ছিল না। আর তাই আগুন লাগতে লাগতে বেঁচে গিয়েছে অনেকবার। একবার হাসান তো তন্দুরের গরম লোহার রড নিয়ে রাস্তা দিয়ে তাড়া করেছিল – মেরেই ফেলব বলে। তার আগে চিমা নাকি চেয়ার ছুঁড়ে মারবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেয়ার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নাকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রেস্তেরার কাঁচের সার্সির ওপর গিয়ে পড়েছিল। হাসান রেস্তেরার মালিকের একটু কাছে কাছে লেপ্টে থাকতে পছন্দ করে। তাই মালিক পক্ষের এমন ক্ষয়ক্ষতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মেনে নিতে না পেরে তন্দুরের লোহার গরম শিক নিয়ে তাড়া করেছিল চিমা কে মেরেই ফেলবে বলে।
বছর কয়েক আগে সিডনীতে গ্রানভিলে শুনলাম একটা ভাল রেস্তেরা হয়েছে। শান দ্যা ধাবা। সপরিবারে গিয়েছি। খুব সুন্দর খাবার। বললাম তোমাদের শেফ কে একটু ডাকবে? শেফ সামনে এসে দাঁড়াতেই বুঝলাম এই সেই আদি অকৃত্রিম চিমা ছাড়া অন্য কেউ নয়। চিমা আমাকে চিনতে পারেনি। খাবারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে পুরনো কাসুন্দি একটু ঘাটতেই ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। পুরনো দিনের টুকিটাকি কথার পরে জানাল যে তাঁকে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তার পর রেস্তেরার চাকরি নিয়ে আবার ফিরে আসে অন্য নামে। তারপরে এদেশে এসে নিজের দেশের একটি মেয়েকে বিয়ে করে থাকার ব্যবস্থা করে। তবে এখন সে সুখেই আছে। কারন তার পাকিস্থানের বউ ও এসে তাদের সংসারে যোগ দিয়েছে। তাই দুই বউ নিয়ে তার ভরা সংসার। সঙ্গে তিন পুত্র সন্তান ও রয়েছে।
আমার কন্যা আমার পাশেই ছিল। দুই বউ এর কথাটা উঠতেই কন্যা আমার উশখুশ করছে। ওদিকে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে চিমা ফলাও করে বলতে শুরু করেছে – দুই বউ নিয়ে থাকার কি সুখ। মেয়ে আমার বেঁকে বসল, এক্ষুনি চলো এখান থেকে। দুই বউ নিয়ে বাস করে এবং সেটা এমন ফলাও করে বলছে – এটা আমার কন্যা মেনে নিতে পারেনি। এমন মানুষ কি করে আমার পরিচিতির তালিকায় এল তা নিয়ে সে ভেবেই আকুল। মেয়ে সবে তখন আঠারো উনিশে পা দিয়েছে কিন্তু হলে কি হবে এখানকার পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এখানকার ভাল টা নিয়ে। আমদের দেশের যেটা ভাল তারও অনেকটা ধীরে ধীরে স্বাদ পেতে শিখছে। দুই বউ নিয়ে থাকে এদেশে, তাও আবার ফলাও করে বলতে পারে – বাবার এমন পরিচিত বন্ধু থাকতে পারে, সেকথা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।
২০০০ সালের অক্টোবরেই অলিম্পিক শেষ হয়ে গেল সিডনীতে। যেন মনে হল দুর্গা পুজোর বিসর্জন হয়ে গেল। সবই আছে, আবার যেন সব ফাঁকা। আমাদেরও অস্ট্রেলিয়ার মত এত সুন্দর একটা দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। এবার পাড়ি জমালাম পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্তে এবং একেবারে বিপরীত গোলার্ধে। দক্ষিণ মেরু থেকে সটান উত্তর মেরু – ক্যানাডা।
১৪ ডিসেম্বর আমরা টরোন্টো বিমান বন্দরে নেমে বুঝলাম ক্যানাডা সম্বন্ধে যা যা ধারনা মনে মনে তৈরি হয়েছিল তা সব ভুল। অস্ট্রেলিয়াতে যতবার যাদের সঙ্গে আমাদের এই যাত্রা নিয়ে কথা হয়েছে তাঁরা যত উচ্ছাস দেখিয়েছেন, আমরা তত রোমাঞ্চিত হয়েছি মনে মনে।বড়দিনের আগেই ক্যানাডার মাটিতে পা রাখব।এবছর আমরা হোয়াইট ক্রিসমাস দেখব – সে নিয়ে আমাদের থেকেও বেশি উচ্ছাস অন্যদের। বিশেষত ক্রিসমাস যাঁদের কাছে আমাদের দূর্গা পুজো, তাদের মধ্যেই এই বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস।তখনও পর্যন্ত ক্রিসমাসের এমন তাৎপর্য নিয়ে আমার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়নি। যে টুকু দেখেছি সেটা সিনেমার পর্দায়।
বিমান বন্দরে নামতেই আমাদের সেই রোমাঞ্চ বাস্প হয়ে উবে গেল। আমরা পৌঁছনর আগের দিন অবিশ্রান্ত তুষারপাত হয়েছে। আমাদের বিমান যখন নামছে তখান সিনেমা দেখছি মনে হচ্ছিল। বিমান বন্দরে নেমে পায়ের নীচে জল ছপ ছপ করতে করতে যেতে যেতে বুঝলাম আরও চমক অপেক্ষা করে আছে। ক্যানাডায় পাকাপাকি ভাবে থাকব বলে মন তৈরি করে এসেছি। তাই বদন আমার খুব কষ্ট করে অম্লান রেখেই বিমান বন্দরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা জায়গায় এসে দেখলাম সারি দিয়ে কুলিরা দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন দেশের লোক। মুলত গরিব দেশ থেকে আসা লোকজন বেছে নিয়েছে এই পেশা। বিমান বন্দরের কুলি। নিমেষে মনে পড়ে গেল আমাদের হাওড়া স্টেশনের কথা। শীতের দেশ আবার ক্যানাডা বলে কথা – মাথায় বাহারি টুপি আর জ্যাকেট। হাতে মাল ঠেলে নিয়ে যাওয়ার ট্রলি। আমাদের দেশে যেমন মাথায় করে সুটকেস বয়ে নিয়ে যায় তেমন নয়। তারপর জল ছপ ছপে বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে সেই যে স্তুপাকার তুষার আর জমে থাকা কালো বরফের ওপর হেঁটে বেড়ানোর আদব কায়দা শেখা শুরু হল – তার আর শেষ নেই।
বাঙালি আত্মঘাতী কি না – সেটা নিয়ে চর্চা বহুদিন ধরেই রয়েছে। বিশেষ করে কলকাতার বাঙালির বিদেশিয়ানাতেই যে বেশি ভক্তি তার ভুরি ভুরি প্রমান রয়েছে। বাংলার যা কিছু, বাঙালির যা কিছু – তার থেকে বাঙালি সব সময়েই বেশি কিছু খুঁজে পেয়েছে অন্য ভাষায়, অন্য দেশে। যা বাংলার নয়, যা বাঙালির নয় তাতেই যেন বাঙালির আকর্ষণ বেশি। এই প্রবনতাকে আতঘাতী আখ্যা দেওয়া যায় কি না তার বিচার করার দ্বায়িত্ব রইল আপনাদের ওপর। আর ভুল হলে সংশোধন করে নেওয়ার দায় আমার। বিচারে সিদ্ধান্ত যাই হোক, এটুকু না বলে পারছি না যে কলকাতার বাঙালিদের মধ্যে এই প্রবনতা অতি মাত্রায় বিরাজমান। সেটা ক্যানাডায় গিয়ে আরও বেশি করে দেখতে পেলাম। পশ্চিম বঙ্গীয় যে বাঙালি কুল কলকাতা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাদের মধ্যে দলে ভারি যারা তাঁরা এসেছিলেন ষাটের দশকের শেষ দিকে বা সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। মানে বাংলার প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতায় রবীন্দ্রনাথের শরনাপন্ন হয়ে বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে এ দেশে আর কিস্যু হবে না তাই – দাও সবে গৃহ ছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে। এক লক্ষীছাড়া বাঙালি প্রজন্মের জন্ম হল। এঁরা যত না বাঙালি তার থেকে বেশি সাহেব। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে ছেলেমেয়েদের আরও অতিমাত্রায় সাহেব-মেম বানিয়ে ক্ষান্ত হলেন। মনে পড়ে গেল ক্যানাডা নিবাসী বাঁকুড়ার এক বাড়ুজ্জে পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন – ওরা কিন্তু বাংলা জানে না। এই আপ্ত বাক্যে তাদের যে চুইয়ে পড়া গর্ব সেটা এক মাত্র পাবেন কলকাতায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাবা-মা এর গলায় যখন বলবে – আমার ছেলে বাংলায় বড্ড কাঁচা!
বাংলাদেশের বাঙালি তুলনায় সহজ সরল দিলদরিয়া মানুষ। জটিলতা কম। নাটকীয়ভাবে আলাপ হয়েছিল ট্যাক্সিচালক নুরুল ইসলাম মোড়লের সঙ্গে। অজ পাড়াগাঁয় বাড়ি বাংলাদেশে। ৫২ বছর বয়েসে তালাক নয় ক্যানাডার আইনে ডিভোর্স পাওয়ার পরের বছরেই বিয়ে করতে যাচ্ছেন। খান চারেক থ্রি পিস স্যুট স্যুটকেসে ঢোকাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। বৈশাখের বাংলাদেশে খান চারেক স্যুট কি কাজে লাগতে পারে জানতে চাইতেই হেসে ফেললেন। বুঝতেই তো পারছেন – বিদেশে থাকি তারপর বিয়ে-শাদির ব্যাপার আছে। এসব না পরলে মান-সম্মান থাকে না, তাই আর কি।
বন্ধু আর বন্ধুত্ব নিয়ে আমার কোনদিনই খুব একটা সমস্যা হয় না। দেশে থাকতেও না। বিদেশেও নয়। অতি মাত্রায় বন্ধু এবং বন্ধুত্বের জন্য আমার নাকি সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা – মা কে কোনও জ্যোতিষী বলেছিলেন। আমার আজ পর্যন্ত মনে হয় যে আমার বন্ধুরা আমাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই রকমই এক বন্ধু হল রনি রায়। বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলা গান এমন দরদ দিয়ে গাইতে পারে আমার দেখা রনি দা আজও পর্যন্ত আমার সেরা প্রাপ্তি। তার পরেই রাখব কলকাতার ছেলে ডঃ রনধীর ঘোষ। সিডনীতে আলাপ। টরন্টোতে রনি দা র সঙ্গে দোলনের তবলার সঙ্গত মন ভরিয়ে রাখত – এটুকু বললে খুব কম বলা হয়ে যাবে। কলকাতাতেও এমন বৈঠকি গানের আসর খুব বেশি দেখিনি। সপ্তাহের শেষ দিকে এসে মন উড়ুউড়ু – আবার গানের আসর সঙ্গে পান আর ভোজনের ব্যবস্থাও থাকত। আর একটা জিনিস ছিল, সেটা হত দোলন কোনও কারনে আসতে না পারলে। তবলা বাজাবার শিকে ছিঁড়ত এই বেড়ালের ভাগ্যে। সেখানেই একদিন এক ওপার বাংলার ভদ্রলোক দুঃখ করে বললেন যে তিনি কলকাতার একজন বেতার শিল্পী কে বেশ কিছু টাকা ধার দিয়েছিলেন তার বিপদের দিনে। এখন তিনি শাসাচ্ছেন ভারতে ঢুকলেই তাঁকে জেলে পুরে দেবেন!
দুর্বৃত্তের অভাব নেই। তবে মুল্যবান মানুষের সংখ্যা সব সময়েই কম। এরকম এক মুল্যবান মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। তার নাম শঙ্কর সরকার। স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল তার ব্যাবসা টরন্টো শহরে। প্রায় শখানেক লোক চাকরি করেন তার ব্যবসায়। পরে গিয়ে একদিন দেখে এলাম বিশাল বড় ফ্যাক্টরি ফ্লোরে কাজ চলছে। মাথার ওপর বিশাল ক্রেন ভারি ভারি জিনিস তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই শহরের মেট্রো রেলের জন্য উচ্চ মানের সুইচ গিয়ার তৈরি হচ্ছে। এহেন শঙ্কর সরকার আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন বেদনাদায়ক, নোংরা, দুর্গন্ধ যুক্ত বহুতলের এক কামরার ফ্ল্যাটে। দেখা করতে এলেন বলে ওনাকে ছোট করব না। আসলে তিনি আমার শ্বশুর মশাইয়ের বাল্য বন্ধু। তার সঙ্গে যুক্ত হল আমাদের টরন্টো তে নতুন এসে গাড়ি না থাকা। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী প্রনতী কাকিমা আমাদের সংগে দেখা করতে এলেন এক শুক্র সন্ধায়। সেই প্রথম দিনের আলাপ শুরুই হল এক বিড়ম্বনার নাটক দিয়ে।
ফেব্রুয়ারী কি বড় জোর মার্চ মাস হবে। চুটিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। চারিদিক সাদা হয়ে রয়েছে। তুষারপাত যেন আর থামতে চায় না। এমন নয় যে টানা হয়েই চলেছে। একদিন দুদিন পরেই আবার শুরু হয়। আর এই শুরু হওয়ার আগে আবহাওয়া এমন হয়ে যায়, আকাশ দেখলেই আন্দাজ করা যায় এই শুরু হবে। আকাশের এই পট পরিবরতন দিনে হলে ঠাওর করা যায় আর রাতে হলে সেই সুযোগ আর থাকে না। শঙ্কর কাকু আর কাকিমা যখন আমাদের বাড়িতে এলেন তখন সন্ধে হব হব করছে। শীতকালের দিনান্তের সূর্যের নিভু নিভু আলোর রেখা তখনও দিগন্ত থেকে মিলিয়ে যায় নি। যে বহুতল পরিবেষ্টিত একটি বহুতলে আমরা থাকতাম তখন, সেখানে গাড়ি রাখার জায়গা খোলা আকাশের নীচে। প্রত্যেকটা বহুতল বেশ পুরনো। মধ্যবিত্ত নয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাই এখানকার বাসিন্দা। গাড়ি রাখার জায়গা কোথায় – এটা ফোনে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না। তাঁর আর একটা কারন হল বাইরে থেকে কেউ এলে গাড়ি রাখার কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই। এবং কোথায় কার গাড়ি রাখার জায়গা তারও যে খুব পরিষ্কার করে নিশানা দেওয়া রয়েছে – তেমনও নয়। এমনিতেই পারকিং নিয়ে এখানে নিত্য ঝামেলা লেগে থাকে। তার ওপরে হাল্কা তুষারপাত হলে তো সোনায় সোহাগা। তুশারপার তো হাত ধরাই – হলেই হয়, একরকম গা সওয়া গিয়েছে। কোনটা কার গাড়ি রাখার জায়গা – সেটা গুলিয়ে ফেলতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। আমি নেমে এসে একটা জায়গা দেখে ওনাকে পারকিং করতে বললাম। বাড়ির গায়েই, শুধু নীচেরতলায় গাড়ি রেখে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে ওপরে গেলাম।
তার একটু পরেই শুরু হল তুষারপাত। আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বাইরে। জানলায় ভারি পর্দা লাগানো। কাঁচের জানলার দুটো স্তর থাকে ঠাণ্ডা আটকানোর জন্য। বাইরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে তিরিশ ডিগ্রির থেকেও নীচে নেমে যায়। তবে ভেতরে সব সময় ঘর গরম করে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘরের তাপমাত্র বাইশ, তেইশ এর মত হয়। ঘরের ভেতরে থাকলে টের পাওয়া যায় না বাইরে শীতের কি তাণ্ডব চলছে।। গল্প করতে করতে যখন টের পাওয়া গেল বাইরে তুষারপাত শুরু হয়েছে, ওনারা দুজনেই বললেন – তাই হলে আর এক জায়গায় যেখানে যাওয়ার ছিল সেখানে আর যাব না। বরং তোমাদের সঙ্গে আরও খানিকটা গল্প করে তারপর বাইরে পরিবেশ একটু ভাল হলে ওঠা যাবে। খুব খুশি হলাম। তার আরও বেশ অনেকটা পরে এবার ওঁরা বললেন – এবার উঠি, আমাদের অনেকটা দূর যেতে হবে। ওঁদের সঙ্গে নীচে নামলাম, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেব বলে। যে বাড়িতে থাকি, তার একতলায় নেমে দেখলাম এই জায়গাটা আমার একেবারেই অচেনা। চারিদিকে সাদা হয়ে রয়েছে। এতক্ষণ বুঝতে পারিনি তুষারপাত বেশ ভালই হয়েছে। প্রত্যেকটা গাড়ির মাথায় এবং গায়ে পুরু আস্তরন।
এবার শুরু হল গাড়ি খোঁজা। গরু খোঁজা বললে কম বলা হবে। গাড়ির নাম্বার প্লেট ও ঢেকে গিয়েছে জমে যাওয়া তুষারে। তুষার তখন বরফ হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে সমস্ত গাড়ির গায়ে। তার মানে যেটা দাঁড়াল – সব গাড়ির একটাই রঙ – সাদা! রাত হতে এবার গাড়ি খুঁজতে এসে নজর পড়ল যে গাড়ির সারি একটা নয়, সাত-আট সারি গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। নিয়নের কমলা আলোতেও সব সাদা। দূরে কোনায় রাখা ডাম্পার – তারও আর রং নেই, সাদা। রাস্তার রং – সেও সাদা। এত রাতে রাস্তার জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করার লোক তাদের প্লাউইং মেশিন নিয়ে আসবে না। শঙ্কর কাকু সত্তরের দশক থেকে এই দেশে। হলফ করে বলতে পারি আমার আগে ওঁরা এমন পরিস্থিতিতে বহুবার পড়েছেন। কলকাতার বর্ষায় কাক ভিজে বাড়ি ফেরেননি এমন কলকাতাবাসী পাবেন না। তাই যস্মিন দেশে যদাচার। মাথার ওপর তাই গোমড়া আকাশ। আজ তারাদের ছুটি। তুষারপাতের রাতে সচরাচর দেখা যায় না। একটা নীলাভ আচ্ছন্নতা মিশে থাকে আকাশে। এটা তুষার এর ওপর আলোর প্রতিফলন। অন্ধকারেও তবু কেন এটা দেখা যায় জানি না। নীল তখন আরও একটু বেশি হয়ে একটা মোহময় পরিবেশ তৈরি করে। দূরে নিয়নের আলোয় একটা নির্লজ্জ কাঠবেড়ালি জঞ্জালের স্তুপের ওপর বসে কি একটা খেয়ে চলেছে। খুব ব্যস্ত। এদিক ওদিক দেখছে আর খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এবার কেউ কেড়ে নেবে।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে এর তার গাড়িতে বরফ সরিয়ে সরিয়ে পরীক্ষা করে একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হল যে গাড়িটা যেখানে পার্ক করা হয়েছিল, সেখানে নেই। তবে গেল কোথায় ? চুরি হয়ে গেল? সে অভিজ্ঞতাও শঙ্কর কাকুর আছে। শো রুম থেকে নতুন বি এম ডবলু কিনে নিয়ে ফিরছিলেন, সেই দিন বাড়ি পৌঁছনর আগে সেই গাড়ি চুরি হয়ে গিয়েছিল। হাসি মুখেই ওঁরা বললেন সেই কাহিনী। হাসি মুখে কেননা – বীমার কোম্পানি তার ব্যবস্থা করেছিল। তাই গাড়ি চুরি নিয়ে ওঁদের দুজনেরই কোন উদ্বেগ নেই। আরও খানিক পরে আবিষ্কার হল যে যেখানে কাকু গাড়িটা পার্ক করেছিলেন সেটা আমাদেরই বহুতলের একজনের বরাদ্দ জায়গা। সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল দেখা যায়নি ভাল করে। ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করলে গাড়ি তুলে নিয়ে যায়। তাদের ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে দেওয়ালের গায়ে। তাদের ফোন করতেই জানাল যে হ্যাঁ, আপনার গাড়ি এখন আমাদের জিম্মায়। এসে নিয়ে যান। তার পর ভিনি, ভিডি ভিসি। লজ্জার একশেষ।
সব শেষে এত কিছুর পরে মনে হয়, এ যেন ভূতের রাজার বর। ১৪ ডিসেম্বের আমরা সিডনি ছেড়ে গিয়ে পড়লাম টরন্টোতে। মজার ব্যাপার হল এই একই দিনে আমরা তিরিশ ডিগ্রির সিডনি থেকে গিয়ে পড়লাম হিমাঙ্কের নিচের তিরিশের টরন্টোতে। টরন্টো পৌছে আমার ভূতের রাজার দেওয়া এক পাটি জুতো কেমন করে জানি না চুরি হয়ে গেল। অগত্যা আটকে পড়লাম সে দেশে কয়ক বছরের জন্য।
এই লেখা প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ পূজো সংখ্যা “রোহিণী” তে।